তুরস্কে অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাপক রক্তপাত, প্রাণহানি ও সামরিক তাণ্ডবের মধ্য দিয়ে অবশেষে নির্বাচিত সরকার উৎখাতের সামরিক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সামরিক-বেসামরিক তুর্কি জনতা।

অভ্যুত্থান চেষ্টা নস্যাতের ঘোষণা দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। তবে জনগণকে রাজপথ না ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছেন এরদোগান। তার আশঙ্কা, অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হলেও যেকোনো মুহূর্তে তা আবার ছড়িয়ে পড়তে পারে।

চরম উত্তেজনা-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছে সরকারপন্থি জনতা ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানী আঙ্কারা ও সর্ববৃহৎ শহর ইস্তাম্বুলের নিয়ন্ত্রণ এখন সরকারপন্থিদের হাতে।

এ অবস্থায় পার্লামেন্টের জরুরি অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে অংশ নেন সরকারি দল একে পাটি ও বিরোধীদল এবং অন্যান্য বড় দলগুলোর সংসদ সদস্যরা। পার্লামেন্টে জাতীয় ঐক্যের জন্য সর্বদলীয় বিবৃতি পাঠ করা হয়। এর আগে তুরস্কের সব দল অভ্যুত্থান চেষ্টার তীব্র নিন্দা জানায় এবং নির্বাচিত সরকার উৎখাতের চেষ্টাকে ভর্ৎসনা করে।

শুক্রবার শুরু হওয়া অভ্যুত্থান চেষ্টার সমাপ্তি হয়েছে শনিবার বিকেলে। এ দিন বিকেলে সেনাপ্রধানের সদরদপ্তরে ১৫০ জন বিদ্রোহী সেনাকর্মকর্তার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অভ্যুত্থান চেষ্টার।

এর আগে বসফোরাস সেতুতে অবস্থান নেওয়া বিদ্রোহী সেনাসদস্যরা জনতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। প্রধানমন্ত্রী ইলদিরিমি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় সামরিক বাহিনীর ২৮৩৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টায় নিহত হয়েছে মোট ২৬৫ জন। এর মধ্যে অভ্যুত্থানপন্থি বিদ্রোহী রয়েছেন ১০৪ জন। আর অভ্যুত্থান প্রতিরোধ করতে গিয়ে সামরিক-বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন ১৬১ জন। এতে আহত হয়েছেন প্রায় ১৫০০ মানুষ।

অভ্যুত্থান চেষ্টার জন্য সরকার দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছায় নির্বাচিত ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে। তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এ ঘটনার সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই।

গুলেন এক সময় প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন। ২০১৪ সালে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁসের জন্য তাকে দায়ী করে এরদোগান সরকার। তারপর তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং তার অনুসারীদের ‘ফেতুল্লাস সন্ত্রাসী বাহিনী’-এর সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু ফেতুল্লাহ তুরস্কের জনগণের একাংশের কাছে খুবই জনপ্রিয়। পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ফেতুল্লাহর সঙ্গে যোগসূত্র থাকার অভিযোগে শনিবার ২৭৪৫ জন বিচারককে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এদিকে জাতীয় সংকটে ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে প্রধানমন্ত্রী ইলদিরিম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। পার্লামেন্টে বক্তব্য রাখার সময় তিনি বলেন, দুঃসময়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার এই দৃষ্টান্ত ইতিহাসে অসাধারণ মুহূর্ত হয়ে থাকবে।

রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালে পার্লামেন্টে আসা এবং সেখানে অবস্থান করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ইলদিরিম বলেন, সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের জন্য এটি একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।

এর আগে তুরস্কের প্রধান চার রাজনৈতিক দলের যৌথ বিবৃতি পার্লামেন্টে পড়ে শোনানো হয়। এতে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানানো হয়। অভ্যুত্থান প্রতিরোধ করতে গিয়ে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও রাজপথ ছাড়েনি সাধারণ মানুষ। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে তারা। শনিবার বিকেলে ইস্তাম্বুলে প্রেসিডেন্ট এরদোগান জনতার উদ্দেশে রাস্তায় নেমে আসেন। তিনি হাত নেড়ে জনগণকে দুঃসাহসীক প্রতিরোধের জন্য ধন্যবাদ জানান।

তুরস্কে অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আরব দেশগুলোতে উল্লাস প্রকাশ করে র‌্যালি ও সমাবেশ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের হামাস উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে র‌্যালি বের করে। তা ছাড়া আরবের বিভিন্ন প্রান্তে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রার্থনা করা হয়। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আরবদের ব্যাপক প্রচার চালাতে দেখা গেছে।

তুরস্কে অভ্যুত্থান প্রতিরোধে যে বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে, তা হলো জনতার প্রতিরোধ। অভ্যুত্থান ঘোষণা করে কারফিউ জারি করলেও তা উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে তুর্কিরা। আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলে জনতার ঢল দেখা যায়। জনগণের হাতে বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করেন।

তা ছাড়া জনগণের গণপ্রতিরোধে থমকে যেতে বাধ্য হয় বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তারা। সেনাবাহিনীর ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়ে গতিরোধের চেষ্টা করার চিত্রও দেখা গেছে। বিভিন্ন স্থানে সমর্পিত সেনাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে জনতা।

তুরস্কে অভ্যুত্থান চেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন বিশ্বনেতারা। নির্বাচিত সরকার উৎখাতের চেষ্টাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন অধিকাংশ বিশ্বনেতা। তারা গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

সূত্র: বিবিসি,আলজাজিরা,আনাদোলু, আরটিএনএন